প্রাইম ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের ভূমিকার কারণেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট বিশ্ববাসীর মনোযোগ পেয়েছে, বিশ্বব্যাপী নানা আলোচনা চলছে। মানবিক দিক বিবেচনা করেই আমরা রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আন্তর্জাতিক চাপে বা যেভাবেই হোক মিয়ানমার সরকার এগিয়ে এসেছে, আলোচনা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপের পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট ধীরে ধীরে সমাধান করতে পারব ইনশাল্লাহ।
জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদানের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ২০ দিনের সফর শেষে দেশে ফেরার পর গতকাল শনিবার সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালের লাউঞ্জে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মানবিক ভূমিকার জন্য বৃটিশ পত্র-পত্রিকা তাঁকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ অর্থ্যাত্ ‘মানবতার মা’ আখ্যায়িত করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক (খালিজ টাইমস) রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মানবিক আবেদনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তাঁকে প্রাচ্যের নতুন তারকা হিসাবে অভিহিত করেছে। এছাড়াও শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের রক্ষা ও তাদের নিরাপদে নিজ দেশে ফেরত নিতে জাতিসংঘে যে ৫ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন তা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। এসব কারণে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানানোর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সংবর্ধনায় সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
বিমানবন্দরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, জাতীয় কর্তব্য হিসেবে মিয়ানমারের এই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। প্রথমে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, খোঁজ নিয়ে দেখলাম যে অত্যাচার হয়েছে, মেয়েদের উপর অত্যাচার, তাদেরকে আশ্রয় দিতে হলো। শেখ রেহানা বলল, ১৬ কোটি লোককে খাওয়াচ্ছো, আর ৫-৭ লাখ লোককে খাওয়াতে পারবে না? আমি সেখানে গেলাম, সবাইকে ডেকে বললাম, আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ মানুষগুলোকে আশ্রয় দেওয়া ও খাওয়াতে হবে।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার আগে তাদের নোয়াখালীর ভাসানচরে পুনর্বাসনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন তারা যেভাবে আছে, সেভাবে থাকতে পারে না। আমি যাওয়ার আগেই নেভিকে টাকা দিয়ে গিয়েছিলাম। ভাসান চরে দুটি সাইক্লোন সেন্টার ও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
শরণার্থীদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ঘোষণা এবং আলোচনার জন্য অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে অগ্রগতি মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী। রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে মিয়ানমারের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। ২৫ অগাস্টের পর বেশ কয়েকদফা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে, সীমান্তে রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে গুলিও চালায় ওই দেশের বাহিনী।
শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ আমাদের ওপর যুদ্ধ পর্যন্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তারা একটা পর্যায়ে এমন একটা ভাব দেখালো যে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ বেধেই যাবে। আমাদের সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড, পুলিশসহ সকলকে সতর্ক করলাম, যেন কোনোমতেই কোনো রকম উসকানির কাছে তারা যেন বিভ্রান্ত না হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি নির্দেশ না দিই। মূল পরিস্থিতি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে ওই সময় তারা নানা ভাবে উসকানি দিয়েছে।
পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর ছবি দেখে কেঁদেছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করতে পেরে দুর্নীতির কথা বলে যে অপমান করা হয়েছে, তার জবাব দিতে পেরেছি। বিশ্বব্যাংক আগে অপপ্রচার করেছে, কিন্তু তারা কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। এখন তাদের দুর্নীতি অনুসন্ধানের তদন্ত দলের প্রধান ব্যক্তির বিরুদ্ধে হাজার হাজার পৃষ্ঠার নথি বেরোচ্ছে। সত্যের জয় তাত্ক্ষণিক হয় না। মিথ্যার জয় তাত্ক্ষণিক। বাংলাদেশকে হেয় করতে চেয়েছিল। পারেনি। দুর্নীতির কথা বলে ওই সময় বিশ্বব্যাংকের তদন্তের নামে মানসিক অত্যাচার করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মার মতো খরস্রোতা নদীতে সুপারস্ট্রাকচার করা বিরাট চ্যালেঞ্জ। অনেকেই সন্দিহান ছিল। আল্লাহর রহমতে আমরা করেছি। ওবায়দুল কাদের স্প্যান বসানোর উদ্বোধনে দেরি করতে চেয়েছিল। ওবায়দুল কাদের বারবার মেসেজ পাঠাচ্ছে, ফোনে কথা হচ্ছে, বলছে, ‘আপনার জন্য দেরি করব’। আমি বললাম, না। দেরি করবা না। আমেরিকান সময় ৩টার দিকে মেসেজ পেলাম সুপারস্ট্রাকচার বসেছে। ওই ছবি দেখে আমরা দুইবোন কেঁদেছি। এর মাধ্যমে অনেক অপমানের জবাব দিতে পারলাম।’
পথে পথে জনতার ঢল
বিমানবন্দর থেকে গণভবন। সর্বত্রই এক অন্যরকম পরিবেশ। দীর্ঘ প্রায় ১৪ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশ যেন জনারণ্য। উত্সবের আমেজে চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। রাজপথ যেন জনসমুদ্র। আর এ দীর্ঘ পথের দু’ধারে দাঁড়িয়ে পুষ্পবৃষ্টি ছিটিয়ে, বাদ্য-বাজনার তালে স্লোগানে স্লোগানে লাখো মানুষ বরণ করে নিয়েছেন তাদের প্রিয় নেত্রীকে। জাতীয় সামরিক জাদুঘরের সামনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে ১৪ দলের বিপুল সংখ্যক এমপি, বিএমএ ও স্বাচিপের নেতৃবৃন্দ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে আসলামুল হক আসলাম ও কাজী ফরিদুল হক হ্যাপির নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীদের উপস্থিতি নতুন মাত্রা যোগ করে।
বিজয় সরণির উড়োজাহাজ ক্রসিংয়ে জাতীয় পার্টির (জেপি) নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেপির প্রেসিডিয়াম সদস্য মফিজুল হক বেবু, এজাজ আহমেদ মু্ক্তা, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন রেনু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দপ্তর সম্পাদক এম. সালাহউদ্দিন আহমেদ, প্রচার সম্পাদক হুমায়ূন কবির তালুকদার রাজু, ক্রীড়া সম্পাদক আলী আব্দুল্লাহ টিংকু, পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক নুরুল ইসলাম মিয়া খান, যুগ্ম প্রচার সম্পাদক মঞ্জুর হাবিব মঞ্জু, যুগ্ম ক্রীড়া সম্পাদক নাসির উদ্দিন তালুকদার জুয়েল, যুগ্ম পরিবেশ সম্পাদক ছাদেকুর রহমান, কেন্দ্রীয় সদস্য সাইদুর রহমান, যুব সংহতির সহ সভাপতি দেলোয়ার হোসেন নান্নু, জেড সেলিম প্রমুখ।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দেওয়া সংবর্ধনা কর্মসূচিতে যোগ দিতে গতকাল ভোর থেকেই ঢাকা ও এর আশপাশের জেলা থেকে বাস, ট্রাক ও ব্যক্তিগত যানে করে নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীর ফেরার পথে অবস্থান নিতে থাকেন। সাড়ে আট থেকে নয়টার মধ্যে বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশ লোকারণ্যে পরিণত হয়।
সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ভিভিআইপি ফ্লাইট ‘অরুণ আলো’ অবতরণ করে। বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জে সংক্ষিপ্ত এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে প্রথমে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সাহারা খাতুন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এরপর ফুল দেওয়া হয় ১৪ দলের পক্ষ থেকে। এ সময় ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম, জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের শিরিন আকতার, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, কমিউনিস্ট কেন্দ্রে ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, ন্যাপের ইসমাইল হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম প্রথমে দলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ভিভিআইপি টার্মিনালের সামনে অভ্যর্থনা জানান। ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর রশীদ, বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মীজানুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, নাঈমুর রহমান দুর্জয়কে সঙ্গে নিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। রামেন্দু মজুমদারের নেতৃত্বে সংস্কৃতিকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় আতাউর রহমান, গোলাম কুদ্দুস, সারা যাকের প্রমুখ সঙ্গে ছিলেন। চিত্রশিল্পী হাশেম খান, কণ্ঠশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা প্রধানমন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। সাংবাদিকদের মধ্যে শুভেচ্ছা জানান প্রবীণ সাংবাদিক রাহাত খান, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, বিএফইউজের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান, স্বদেশ রায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এফবিসিসিআই, বিজিএমইএসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রীকে। সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাকে বহনকারী গাড়ি বহরটি গণভবনের উদ্দেশে রওনা হয়। এ সময় রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী হাত নেড়ে অভিবাদনের জবাব দেন। সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে পৌঁছেন।
বিমানবন্দর থেকে গণভবন পুরো পথ আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো হয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানান। হাতে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে তারা দাঁড়িয়ে ছিলেন সড়কের দুই ধারে। কেউ কেউ গানে গানেও শুভেচ্ছা জানান শেখ হাসিনাকে। তবে শৃঙ্খলা বজায় থাকায় তেমন কোনো জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়নি।