প্রাইম ডেস্ক :
রাজশাহীর হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালে পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রেমিক যুগল খুনের দেড় বছর পর রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। প্রতিশোধ নিতে চার বন্ধু তরুণীকে ধর্ষণের পর দুইজনকেই হত্যা করে পালিয়ে যায়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) একটি ফোনকলের সূত্রধরে চাঞ্চল্যকর এ জোড়া খুনের ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করেছে। যাদের একজন শুক্রবার রাজশাহী মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই জবানবন্দিতে তিনি তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, জবানবন্দি প্রদানকারী যুবক আহসান হাবিব ওরফে রনি (২০) পাবনার ফরিদপুর থানার জন্তিহার গ্রামের জনৈক এনামুল হকের ছেলে। তিনি রাজশাহী বরেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি রাজশাহীতেই অবস্থান করছিলেন। তবে পিবিআই সদস্যরা তাকে সম্প্রতি ঢাকা থেকে গ্রেফতার করেছে। নিহত মিজানুর রহমান ও তার বন্ধু হাবিবের একটি ফোনকলের সূত্রধরে পিবিআই তাকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করে বলে জানা যায়।
এদিকে হাবিবের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই সদস্যরা বৃহস্পতিবার মহানগরীর একটি ছাত্রাবাস থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ, রাজশাহী কলেজের ছাত্র আল আমিন ও উৎসকে গ্রেফতার করেছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২২ এপ্রিল রাজশাহীর গণকপাড়ায় অবস্থিত হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের ৩০৩নং কক্ষ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমান এবং বিছানায় মুখ থেলানো অবস্থায় পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া নাসরিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মিজানুরের মরদেহ সুমাইয়ার ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলানো ছিল। আর সুমাইয়ার লাশ বিছানায় উপুড় করে রাখা ছিল।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদুল ইসলাম শুক্রবার বিকেলে হাবিবের জবানবান্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দিতে হাবিব বলেছেন, রাহাত মাহমুদের সঙ্গে প্রথম থেকে সুমাইয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরে মিজানুর রহমানের সঙ্গে নতুন করে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। এনিয়ে রাহাত প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পরিকল্পনা করেন। এদিকে রাহাতের সঙ্গে হাবিবেব আগে থেকে পরিচয় ছিল। রাহাত নগরীর বিনোদপুরের একটি ছাত্রাবাসে থাকতেন। সেখানে তিনি হাবিবকে ডেকে নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলেন। মিজানুরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কথা শুনে হাবিব বলেন, মিজানুরকে তিনি চেনেন। মিজানুরের এক পা ছোট।
অন্যদিকে মিজানুরের সঙ্গে দেখা করার জন্য সুমাইয়া রাজশাহীতে এসেছিলেন। মিজানুর তাকে নাটোরের বনপাড়া থেকে এগিয়ে নিয়ে আসেন। সে সময় হাবিবকে ফোন করে মিজানুর জানতে চান শহরের কোন হোটেলে উঠলে ভালো হয়। হাবিব তাকে হোটেল নাইসে উঠার পরামর্শ দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২১ এপ্রিল তারা প্রবেশপথ এড়িয়ে পার্শ্ববর্তী একটি ভবন হয়ে হোটেল নাইসের তাদের রুমে ঢুকে। কিন্তু রুমে শুধু সুমাইয়াকে পায়। সেখানে তারা চারজনে মিলে সুমাইয়াকে ধর্ষণ করেন। এরপর তারা ফোন করে বাইরে থাকা মিজানুরকে ডাকার জন্য সুমাইয়াকে চাপ দেন। সুমাইয়া বাধ্য হয়ে মিজানুরকে মোবাইল ফোনে ডেকে আনেন। সুমাইয়ার ফোন পেয়ে মিজানুর রুমে আসেন। পরে হোটেল কক্ষে তারা প্রথমে মিজানুর রহমান এবং পরে সুমাইয়াকে হত্যা করেন।
জবানবন্দিতে আহসান হাবিব স্বীকার করেছেন হোটেল কক্ষে মিজানুর রহমানকে প্রথমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। সুমাইয়া পুলিশের মেয়ে বলে ঘটনা ফাঁস হওয়ার ভয়ে তারা তাকেও মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন।
উল্লেখ্য, লাশ উদ্ধারের দিন (২২ এপ্রিল) সুমাইয়ার বাবা আব্দুল করিম নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে তরুণ-তরুণী দুজনকেই হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় হত্যার অভিযোগ করা হয়। মামলায় আরো অভিযোগ করা হয় তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
জানা যায়, চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম বাদশা। পাশাপাশি মামলাটির ছায়া তদন্ত করছিল পিবিআই। তবে পুলিশ পরিদর্শক মামলাটি তদন্ত শেষে সুমাইয়াকে ধর্ষণের পরে হত্যা করে মিজানুর রহমান নিজেই আত্মহত্যা করেছেন বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সুমাইয়ার বাবা আব্দুল করিম আদালতে নারাজি আবেদন করেন। পরে আদালতের নির্দেশে পিবিআই ফের মামলাটির তদন্ত শুরু করে।
এ ব্যাপারে মতামতের জন্য যোগাযোগ করা হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলাম শনিবার সন্ধ্যায় ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ঘটনাটি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে। আমরা চাঞ্চল্যকর এ জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছি। শিগগিরই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
এ ব্যাপারে হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের মালিক খন্দকার হাসান কবির শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, মাস ছয়েক আগে পিবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তারপর কি হয়েছে জানিনা।