প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সূর্যই এই পৃথিবীর সকল শক্তির উত্স। সবুজ বৃক্ষরাজি সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে যে শর্করা উত্পাদন করে, তাহাই সার্বিকভাবে জীবজগতের সবার উদরপূর্তি করিয়া থাকে। যে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর ভর করিয়া এই বিশ্ব সচল রহিয়াছে, তাহার অন্তর্নিহিত শক্তির উত্স ওই সূর্যই। শিল্পবিপ্লবের পর হইতে সভ্যতার উন্নয়নধারা ও আধুনিক জীবন সচল রাখিতে জীবাশ্ম জ্বালানিই হইয়া উঠিয়াছে প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে আসিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি উপজাত গ্রিনহাউস গ্যাসের বিপজ্জনক মাত্রায় নিরন্তর নিঃসরণে নড়িয়া-চড়িয়া বসিয়াছে এই বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের যে আলামত আজ ক্রমশ স্পষ্ট হইতেছে—তাহাতে পুরা বিশ্বই অন্তত একটি বিষয়ে একমত যে, গ্রিনহাউস গ্যাসের এই নিরন্তর নিঃসরণের লাগাম টানিয়া ধরিতে না পারিলে মানবজাতি অস্তিত্বের সংকটে পড়িবে। আর ইহার জন্য আমাদের ফিরিয়া যাইতে হইবে ওই সূর্যের কাছেই—প্রত্যক্ষভাবে। সৌরশক্তির মাধ্যমে যদি নবায়নযোগ্য বিদ্যুত্ উত্পাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করা যায়, সাশ্রয়ী করা যায়—তাহা হইলে ক্রমশ লাগাম টানিয়া ধরা সম্ভব হইবে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণের।
এই কারণে বিশ্বজুড়িয়া সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাইতেছে ব্যাপক হারে। উন্নত দেশসমূহ প্রযুক্তিতে অনেক বেশি অগ্রগামী হইলেও সৌরবিদ্যুতের জনপ্রিয়তা বেশি এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশসমূহে—বিশেষ করিয়া চীন, ভারত ও বাংলাদেশে। বাংলাদেশে বত্সরে গড়ে প্রায় তিন শত দিন পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকে। সেই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ কিলোওয়াট ঘণ্টা সৌরশক্তি এই দেশের প্রতি বর্গমিটার জমিতে আছড়াইয়া পড়ে। ভূপতিত এই সৌরশক্তির মাত্র ০.০৭ শতাংশ শক্তিতে রূপান্তর করা গেলেই বাংলাদেশের বিদ্যুতের সম্পূর্ণ চাহিদা মিটাইয়া ফেলা সম্ভব। জানা যায়, পৃথিবীর সবচাইতে বেশি সৌরবিদ্যুত্ প্যানেল স্থাপনকারী দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ৮১ শতাংশই আসে সৌরবিদ্যুত্ হইতে। যদিও মোট চাহিদার তুলনায় বর্তমানে বিদ্যুত্ উত্পাদন এক-শতাংশেরও কম। তবে ওইটুকুর মাধ্যমেই দেশের প্রায় সোয়া কোটির মত মানুষ উপকৃত হইতেছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রেও অবদান রাখিতেছে এই সৌরবিদ্যুত্। আশার কথা হইল, সৌরবিদ্যুতের বিস্তারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করিতেছে সরকারের বর্তমান নীতি ও প্রচেষ্টা। যদিও সোলার প্যানেল বসাইতে এখনো যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহা গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের সাধ্যের বাহিরে। অন্যদিকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে খরচ পড়ে ৩০ হইতে ৩৫ কোটি টাকা। ইহার বিপরীতে গ্যাস বা ডিজেলের জেনারেটর বসাইতে ব্যয় হয় ১০ কোটি টাকারও কম।
এইক্ষেত্রে সোলার প্যানেলের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর জোর দিতে হইবে সবচাইতে বেশি, যাহাতে সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া সম্ভব হয় এই পরিবেশবান্ধব বিদ্যুত্। নচেত্ ইহা প্রচলিত বিদ্যুত্ উত্পাদন পদ্ধতির বিকল্প হইয়া উঠিতে পারিবে না। অথচ শেষাবধি কোনো এক সময় আমাদের এই সৌরশক্তির কাছে ফিরিয়া যাইতে হইবেই।