কালিমুল্লাহ ইকবাল, টঙ্গী থেকে :
আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা গতকাল রবিবার সকালে শেষ হয়েছে। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্বের ন্যায় দ্বিতীয় পর্বেও বাংলায় মোনাজাত করা হয়। তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বী বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ হযরত মাওলানা যোবায়ের আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করেন। মোনাজাতে লাখো মুসলী মুসলিম উম্মাহ ও বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর শান্তি কামনা করে মহান আলাহ তাআলার দরবারে দু’হাত তুলে অশ্র“সজল নয়নে আহাজারী করেছেন প্রায় ২৬ মিনিটব্যাপী। বেলা ১০টা ২০মিনিটে মোনাজাত শুরু হয়ে ১০টা ৪৬মিনিটে শেষ হয়। মোনাজাতের সময় লাখ লাখ মুসলীর আলাহুমা আমিন আলাহুমা আমিন ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠে টঙ্গীর পুরো এলাকা।
আখেরী মোনাজাতে যোগদিতে রবিবার ভোর থেকে মানুষ ছুটতে থাকে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের দিকে। ইজতেমা প্যান্ডেলসহ এর আশপাশ এলাকা মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে যায় মোনাজাত শুরুর আগেই। ছুটে আসা মুসলীরা আলাহর দরবারে গুনাহ মাফের জন্য কান্নাকাটি করেছেন অজড়ধারায়। মানুষের আহাজারিতে টঙ্গীর পুরো এলাকা রূপ নেয় কান্নার রোলে। নিজের গুনা মাফের জন্য দু’হাত তুলে আলাহর দরবারে কান্নাকাটি করে। প্রথম পর্বের ইজতেমা শেষে শুক্রবার শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা। আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হলো এবারের ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমা।
লাখ লাখ মানুষ রাস্তার উপর, বাড়ির ছাঁদে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে বসে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। দোয়ায় নবী করিম (সা:) এর তরীকা মনের মধ্যে পয়দা করার তৌফিক দান, গোণাগার বান্দাদের দোয়া কবুল, গুণা মাফ করে জানমাল কোরবানী দেওয়ার তৌফিক দান, মুসলমানদের জানমাল হেফাজত, মুসমানদের দেশকে হেফাজত, ইমানী জিন্দেগী, ইমান আখলাককে কবুল, ঈমানের দ্বীনের কাজকে মজবুত করে দেয়া, আলাহ হাবিবের সুন্নতের পথে চলার তৌফিক দান, নবীর সুন্নতকে নসিব করার, নবীর হাওজে কাউসারের পবিত্র পানি পান করার নসিব এবং আমলনামা ডান হাতে দেওয়ার ও দ্বীনের পথে এবং আখিরাতকে কবুল নসিব করার এবং দুনিয়াধারী না হয়ে আখিরাতী বানানোর জন্য লাখো মুসলী দু’হাত তুলে দোয়ায় অংশ নেন।
ট্রেন, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, জিপ, কার এবং নৌকাসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে ইজতেমা ময়দানে পৌঁছান ধর্মপ্রাণ মুসলিরা। এছাড়া রবিবার ভোর থেকেই রাজধানীর খিলক্ষেতস্থ বিশ্বরোড থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হলে যানবাহনের অভাবে মুসলিরা সকাল থেকেই দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে ইজতেমা অভিমুখে ছুটতে থাকেন। সুষ্ঠুভাবে বিশ্ব ইজতেমার অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে বিপুল সংখ্যক র্যাব, পুলিশ এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হয়।
আখেরী মোনাজাত শেষে লাখো মুসলীগণ তাদের নিজস্ব গন্তব্যে যেতে যানবাহন সংঙ্কটে পড়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন। মোনাজাত শেষে লাখ লাখ মুসলী এজতেমা ময়দান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে স্রোতের মতো এক সাথে ফিরতে শুরু করলে এক পর্যায়ে ময়দানের চতুর দিকে ৬/৭ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকায় মানব বলয় সৃষ্টি হয়। এসব এলাকার সকল রাস্তায় এক পর্যায়ে মুসলীদের বাড়ি ফেরার কাফেলায় পরিণত হয়। সড়ক-মহাসড়কগুলোতে মুসলীর বাড়ি ফেরার স্রোতে কোন যানবাহন চলাচল করতে না পাড়ায় মুসলীরা পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন। এদিকে ভোর থেকে টঙ্গী থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার ও টঙ্গী থেকে পূবাইল পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার, টঙ্গী-আব্দুলাহপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার, টঙ্গী থেকে আশুলিয়া সড়কের ৫/৬ কিলোমিটার পর্যন্ত এজতেমামুখী সকল যানবাহন চলাচল মুসলীদের মোনাজাত শেষে বাড়ি ফেরার জন্য বন্ধ রাখা হয়। এতে মুসলীরা পায়ে হেঁটেই ওই সকল দূরত্বের পথ পাড়ি দিয়ে মোনাজাত শেষে যে যার গন্তব্যে পৌঁছতে দেখা যায়।
আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল¬ীও আগের দিন রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশেপাশে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাঁদে বসে আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়। ইজতেমায় মহিলাদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা না থাকায় যে যেখানে পেরেছেন সেখানে বসেই লাখো মুসলীর সাথে মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা গেছে। আখেরী মোনাজাতের সময় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও মোবাইলের মাধ্যমে বাড়ি-ঘরে বসে লাখ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়।
এবারের বিশ্ব ইজতেমায় নজীরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ৮ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ৭ হাজারের অধিক পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি দায়িত্বরত ছিল সাদা পোষাকী গোয়েন্দা পুলিশ। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে আকাশে র্যাবের হেলিকপ্টার টহল, নৌ-পথে স্পীড বোটে সতর্ক টহল ও নজরদারী। আকাশ ও নৌ-পথের পাশাপাশি সড়ক পথগুলোতে খালি চোখ ছাড়াও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাইনোকুলার দিয়ে মুসলীসহ সকলের চলার পথ ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে স্থাপিত র্যাবের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মনিটরিং করা হয়েছিল। গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ বিশ্ব এজতেমা উপলক্ষে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন।
বিশ্ব তাবলীগ জামাতের মুরুব্বীগণ জানান, সারা বিশ্বে তাবলীগের দাওয়াত পৌঁছে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে ইজতেমায় শরীক হওয়া মুসলীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের সময় টঙ্গী তুরাগ তীরের এ বিশাল ময়দানেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না। আগত মুসল¬ীদের যাতায়াতের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাই বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীদের অসুবিধা ও দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে ২০১১ সাল থেকে দুই দফায় ইজতেমা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। যাঁরা প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেননি। প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাত শেষে মুসলীগণ ময়দান ছেড়ে দেওয়ার পর মাঝে ৪দিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু হয়।
গাজীপুর জেলা তথ্য কর্মকর্তা এসএম রাহাত হাসনাত জানান, ভিড়ের কারণে যারা মূল ময়দানে যেতে পারবেন না, আখেরি মোনাজাতে তাদের শরিক হতে টঙ্গীর মধুমিতা রোড, টঙ্গী বিসিক এলাকা, নোয়াগাঁও এবং চেরাগআলী, টঙ্গী স্টেশন রোড, রেল স্টেশন, মেঘনা রোড, কামারপাড়া, উত্তরা বিমানবন্দর সড়ক এর আশপাশের প্রায় ১০কিলোমিটার পর্যন্ত অতিরিক্ত মাইকের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।
আখেরী মোনাজাত শেষে চিলায় নাম লেখানো জামাতবন্দী মুসলীরা ঢাকার কাকরাইল মসজিদে গিয়ে রিপোর্ট করে তাবলীগের মুরুব্বীদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী জামাতবন্দী হয়ে দ্বীনের দাওয়াতী মেহনতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন। এসব জামাতবন্দীদের মধ্যে ৪০দিন, ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর চিলাধারী মুসল¬ীগণ রয়েছেন। তারা বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতি কাজে দ্বীন ও ইসলামের মেহনত করবেন।
বিশ্ব ইজতেমার মুরুব্বি ইঞ্জিনিয়ার মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, আগামী বছর বিশ্ব ইজতেমা ১১ জানুয়ারি ২০১৯ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হবে। কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ মুরুব্বিদের এক পরামর্শ সভায় ওই তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী বছর বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব ১১, ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এবং চারদিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্ব ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে।
২০ টাকায় ভ্যান, ৫০ টাকায় অটো
আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দলে দলে মুসলিরা ইজতেমা ময়দানের দিকে ছুটতে থাকেন। প্রধান সড়কে গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় মোনাজাতে শরিক হতে পায়ে হেঁটেই রওনা দেন অনেক মুসলি। রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে এসব যানচলাচল বন্ধ থাকে। তাই এ রাস্তায় পায়ে হেঁটেই পৌঁছানোর চেষ্টা ছাড়াও অনেকে ইজতেমা ময়দানে পৌঁছাতে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল, পিকআপ, সিএনজি অটোরিকশা বা ভ্যানগাড়ির আশ্রয় নেন।
মুসলিদের ইজতেমা ময়দানে পৌঁছে দিতে নিজের ব্যক্তিগত মোটরসাইকলে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন অনেকেই। তারা ভাড়ার বিনিময়ে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে আব্দুলাপুর পর্যন্ত মুসলিদের পৌঁছে দেন ১০০ টাকার বিনিময়ে। এছাড়া সিএনজি অটোরিকশায় জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয় ৫০ টাকা। আর পিকআপ ও প্যাডেলচালিত ভ্যানে বিমানবন্দর পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয়েছে ২০ টাকা করে।
একই মোটরসাইকেলে চড়ে আব্দুলাহপুর গিয়ে মোনাজাতে অংশ নেয়া মুসলীরা জানান, খিলগাঁও থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত বাসে চড়ে এসেছি। এরপর থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় মোটরসাইকেলে করেই আসলাম। কিন্তু সুযোগ বুঝে এরা ভাড়া বেশি আদায় করেছে। আব্দুলাহপুর পর্যন্ত ১০০ টাকা না হয়ে ৫০ টাকা হওয়া উচিত ছিল।
এছাড়া অনেকেই সিএনজি অটোরিকশা, পিকআপ, প্যাডেলচালিত ভ্যানগাড়িতে চড়ে ইজতেমার দিকে এগিয়ে যান। সেখানে মুসলিদের কাছে সিএনজি চালকরা ভাড়া নেয়া হয় ৫০ টাকা। আর পিকআপ ও প্যাডেলচালিত ভ্যানে ভাড়া নেয়া হয় জনপ্রতি ২০ টাকা করে।
ইজতেমা ঘিরে ছিল জমজমটা মৌসুমি ব্যবসা
টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে বাহারি সব ব্যবসা খুলে বসেছিলেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি হকার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ছিল জমজমাট ব্যবসা। টঙ্গীর তুরাগ পাড় ছাড়াও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা রাস্তার দুই পাশে তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন। ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শেষে মুসলিরা পায়ে হেঁটেই ফিরছেন অনেকেই। এসব মুসলিদের জন্য রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। রাস্তার দুপাশে বসে এমন অসংখ্য অস্থায়ী দোকান। সেখানে বিক্রি হয় আতর, টুপি-জায়নামাজ, তসবিহ, চাদর, কম্বল ও জ্যাকেট।